পাঁচ দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া অঞ্চল। প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতের জেরে সৃষ্ট এই বন্যায় কয়েক ডজন মানুষ নিখোঁজ রয়েছে।
গত মঙ্গলবার মুষলধারে বৃষ্টির ফলে আকস্মিক এই বন্যার সৃষ্টি হয়। এতে ডুবে গেছে রাস্তা-ঘাট ও বাড়িঘর। ফলে প্রাণ বাঁচাতে মানুষ বাড়ির ছাদে উঠতে বা গাছ আঁকড়ে থাকতে বাধ্য হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ চরম পরিস্থিতি অব্যাহত থাকায় বুধবার থেকে তিন দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছেন। অনেক মানুষ নিখোঁজ থাকায় মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে দেশটির সরকার।
ভ্যালেন্সিয়া ও আশেপাশের এলাকায় কমপক্ষে ৯৫ জনের মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে, যা ১৯৭৩ সালের পর সর্বোচ্চ। ওই বছর দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যায় কমপক্ষে ১৫০ জন মারা গিয়েছিল।
পেদ্রো সানচেজ বুধবার ভাষণে নাগরিকদের সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘পুরো স্পেন আপনাদের সঙ্গে কাঁদছে। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি।”
জাতীয় আবহাওয়া সংস্থা এইএমইটির মতে, ভ্যালেন্সিয়ার কাছের একটি শহর চিভায় মঙ্গলবার মাত্র আট ঘণ্টার মধ্যে এক বছরের সমান বৃষ্টিপাত হয়। সেদিন সেখানে ৪৯১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া দপ্তর, যা শহরটির প্রায় এক বছরের বৃষ্টিপাতের সমান।
এমন অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট আকস্মিক পানির প্রবাহ রাস্তা ও হাইওয়েগুলোকে নদীতে রূপান্তরিত করে। সেতুগুলোও ডুবে যায়। ডুবে যায় সব ভবন। এতে মঙ্গলবার রাতে লাখ লাখ মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়ে।
বুধবার সকাল থেকে দেশটির সেনাবাহিনী উদ্ধার অভিযানে নামে। বাড়ির ছাদ, গাড়ির ছাদ, সেতু এবং গাছ থেকেও বহু মানুষকে উদ্ধার করা হয়।
ভ্যালেন্সিয়ার পাইপোর্টারের বাসিন্দা ২১ বছর বয়সী গুইলারমো সেরানো পেরেজ বলেছেন, রাস্তা দিয়ে ‘সুনামির মতো’ পানি আসতে দেখে তিনি এবং তার বাবা-মা তাদের গাড়ি থেকে দৌড়ে বের হয়ে একটি সেতুতে আশ্রয় নেন।
আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী একটি দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছেন, যেখানে মোটরওয়ে চালকরা পানির স্রোত আসতে দেখে মানববন্ধন তৈরি করে ভেসে যাওয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করেন।
প্যাট্রিসিয়া রদ্রিগেজ (৪৫) এল পাইস পত্রিকাকে বলেন, “ভাগ্য ভালো যে কেউ পিছলে যায়নি। কেউ যদি পড়ে যেত, তাহলে পানির স্রোত তাদের টেনে নিয়ে যেত।”
লা টোরের এক বাসিন্দা বিবিসিকে বলেছেন, তার কিছু বন্ধু তাদের বাড়ি হারিয়েছে এবং মঙ্গলবার রাতে তিনি পানিতে গাড়ি ভাসতে দেখেছেন। পানির স্রোত অনেক বাড়ির দেয়ালও ভেঙ্গে দিয়েছে।
এদিকে, ভ্যালেন্সিয়ার ঠিক বাইরের শহর হর্নো দে আলসেডোর মেয়র কনসুয়েলো তারাজন বিবিসি নিউজ আওয়ারকে বলেছেন, মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে এক মিটারের চেয়ে বেশি উঁচু পানির ঢেউ তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, “খুব দ্রুত পানির উচ্চতা বেড়ে গিয়েছিল। আমরা জরুরি পরিষেবাগুলোতে কল দিয়েছিলাম, যারা এসে গলাপানি থেকে মানুষকে উদ্ধার করতে শুরু করে।”
স্পেনে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে যে, অনেক ক্ষেত্রেই দুর্যোগ ত্রাণ কর্তৃপক্ষ সতর্কতা জারিতেও ধীরগতিতে কাজ শুরু করে। ফলে লোকে রাস্তা থেকে সরে যেতে পারেনি।
জাতীয় দুর্যোগের সময়ের জন্য নিয়োজিত নাগরিক সুরক্ষা সংস্থা স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৮ টা ১৫ মিনিট পর্যন্তও কোনও সতর্কতা জারি করেনি । অথচ ততক্ষণে, চিভা এবং অন্যান্য কয়েকটি শহর কমপক্ষে দুই ঘন্টার জন্য প্লাবিত হয়েছিল।
বুধবার উদ্ধারকাজে সহায়তার জন্য ১ হাজারেরও বেশি সেনা মোতায়েন করা হয়। কিন্তু বন্যায় প্লাবিত রাস্তা এবং যোগাযোগ ও বিদ্যুতের লাইন ভেঙে পড়ায় অনেকেই শহরে প্রবেশ করতে পারেনি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান উরসুলা ভন ডের লিয়েন বলেছেন, উদ্ধারকারী দলকে সমন্বয় করতে সহায়তার জন্য তারা কোপার্নিকাস স্যাটেলাইট সিস্টেম সক্রিয় করেছে। অন্যান্য ইউরোপীয় প্রতিবেশীরাও সহায়তা পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছে।
বুধবার দেশটির মধ্য-পূর্বে বৃষ্টিপাত কমেছে। তবে আবহাওয়া কর্মকর্তারা সতর্ক করেছেন যে, বৃষ্টি উত্তর-পূর্ব দিকে কাতালোনিয়া অঞ্চলে চলে যাচ্ছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে আবহাওয়া সতর্কতাও জারি করা হয়েছে। মানুষকে বন্যার জন্য প্রস্তুত হতে এবং নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি