১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের দিন। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র সংগ্রাম করে বহু প্রাণ আর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এদিনে বীর বাঙালি ছিনিয়ে আনে বিজয়ের লাল সূর্য।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের মুক্তিকামী মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের পর এদিন আত্মসমর্পণ করে মুক্তিকামী মানুষের যৌথ-বাহিনীর কাছে। আর পাকিস্তানি বাহিনীর এই আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে দীর্ঘ দুই যুগের পাকিস্তানি শোষণ আর বঞ্চনার। নির্যাতন, নিষ্পেষণের কবল থেকে মুক্ত হয় বাঙালি জাতি। এ স্বাধীনতা নিছক ঘরে বসে পাওয়া যায়নি। পেতে হয়েছে দীর্ঘ লড়াই করে। হারাতে হয়েছে অনেক বীর সন্তানকে। কত বীর শহীদ হয়েছেন হাসিমুখে। এ লড়াই ছিল দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য।
কিন্তু স্বাধীন দেশে আমাদের দেশের শাসকরা সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হননি। অনেক ক্ষেত্রেই তারা বরং অধিকার হনন, স্বাধীনতা খর্ব করার প্রয়াস চালিয়েছে। যখন যে দল ক্ষমতায় গেছে, তারাই একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা চালিয়েছে। প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বাড়িয়েছে। যারা ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে, তারা সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। বাক্স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। হস্তক্ষেপ করা হয়েছে ব্যক্তিস্বাধীনতায়। তৈরি করা হয়েছে মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে জিইয়ে রাখার পরিবেশ। ধর্মীয় মেরুকরণের মধ্য দিয়ে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরি, আর মৌলিক অধিকার হনন বর্তমান বাংলাদেশে আবারও সেই পাকিস্তানি আইয়ুব-ইহাহিয়ার শাসনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
প্রশ্ন উঠেছে যে, বিজয় দিবস মানে কি শুধু একটা ১৬ ডিসেম্বরের সকাল? দেশের স্বাধীনতার জন্য, বিদেশি শাসকের হাত থেকে দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের জন্য, যে সব বীর জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করে হাসিমুখে জীবনোৎসর্গ করেছিলেন, সেই সব বীর সেনানীর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান শুধু?
না, বিজয় দিবস মানে আরও বেশি কিছু। বিজয় দিবস মানে একটা সংকল্প ও অঙ্গীকার গ্রহণের দিন। বিজয় দিবস মানে শোষণ ও বঞ্চনার অবসানের সংকল্প। দুর্নীতি আর কালোবাজারির, অন্যায় ও অবিচারের, অশিক্ষা ও অন্ধকারের, দারিদ্র্য ও অপুষ্টির, অসাম্য ও নিরাপত্তাহীনতা থেকে মুক্তি। জীবনযন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে যাওয়া থেকে রেহাই পাবার অঙ্গীকার।
কিন্তু তেমন প্রতিশ্রুতি কি মিলছে? কালো টাকায় দেশ ভরা। এক শ্রেণির নেতা-মন্ত্রী-আমলা-ব্যবসায়ীর কোটি কোটি টাকার আর্থিক দুর্নীতি, পাচার আর কেলেঙ্কারিতে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে মুখ দেখানো লজ্জার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিপন্ন দেশের অর্থনীতি। অথচ কেলেঙ্কারিতে জড়িত তথাকথিত উচ্চশ্রেণির মানুষ বিপুল ক্ষমতা আর অর্থের জোরে অন্ধকার থেকে যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে এসে আবার রচনা করছে নতুন কেলেঙ্কারির বুনোট।
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে! তাদের অপকীর্তির ফলে নষ্ট হচ্ছে অর্থনৈতিক ভারসাম্য। বাড়ছে মুদ্রাস্ফীতি। বাজারে আগুন। মুখ থুবড়ে পড়ছে গরিব মানুষ। দিনগুজরান করতে হিমশিম খাচ্ছে। অপুষ্টি। অনাহার। অকাল মৃত্যু। যে সমাজে শিশুরা খেতে পায় না পেট ভরে, অপুষ্ট শীর্ণ দেহে একমুঠো ভাতের জন্য লাঠি ঝাঁটা খেয়ে কাজ করে দোকানে, কারখানায় কিংবা বড়লোকের বাড়িতে, সেই সমাজে স্বাধীনতার আলো পৌঁছবে কী করে? ফলে শোষণ, বঞ্চনা, বাল্যবিবাহ, নারী নির্যাতন, দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত পক্ষাঘাতগ্রস্ত একটা সমাজ তৈরি হয়েছে।
এমন সমাজে কিসের ১৬ ডিসেম্বর, কিসের বিজয়? ১৬ ডিসেম্বর মানে মাইকে কিংবা সাউন্ড সিস্টেমে উচ্চস্বরে দেশাত্মবোধক গান বাজানো নয়। বিজয় দিবসের অর্থ— দেশকে একটি সুদৃঢ় ভিতের উপরে দাঁড় করানো, দেশের মানুষের নূন্যতম প্রয়োজন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বস্ত্র ও বসবাসযোগ্য স্থানের চাহিদা পূরণে সক্ষম করে তোলার সঙ্গে কর্মসংস্থান ও বিজ্ঞান চিন্তায় দীক্ষিত করে তোলা, দেশকে স্বনির্ভর করে তোলা।
বিজয় দিবসের অর্থ মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচারণ করা ব্যক্তিদের উল্লাস নয়, বরং বিজয় দিবসের অর্থ স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী ঘাতক-দালালদের উপযুক্ত বিচার করে রাষ্ট্রকে পবিত্র করা। কিন্তু আমরা কেমন যেন সেই কর্তব্য থেকে সরে যাচ্ছি। ঘাতক-দালালদের অট্টহাসি বিজয় দিবসকে যেন উপহাস করছে!
বিজয় দিবসের প্রধান অঙ্গীকার হওয়া উচিত আমাদের সেই অপহৃত মুক্তিযদ্ধের চেতনাকে যথাস্থানে পুনঃস্থাপন। এ জন্য নতুন প্রজন্মকে একাট্টা হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধব্যবসায়ী ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের হাত থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে রক্ষা করতে হবে। এ জন্য নতুন নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। দেশের উন্নতি তখনই সম্ভব যদি সঠিক নেতৃত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। আমাদের সবার উচিত দেশের স্বার্থে ও নিজেদের স্বার্থে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা। সবাই যদি চিন্তা করি রাজনীতি খারাপ, তার ফলস্বরূপ দেশের সমস্ত নাগরিকও খারাপ থাকতে বাধ্য। দেশের নাগরিকরা ছাড়া দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। নিজেদের স্বার্থে দেশের স্বার্থে ভালো নেতা দরকার। যোগ্য-দক্ষ-সৎ ব্যক্তিত্ব ছাড়া ভালো নেতৃত্বের জন্ম হয় না।
পচা পাঁকে বাস করে পঙ্কজ সর্বদা হওয়া যায় না। তাই প্রথমে উচিত পচা পাঁক সরিয়ে ভালো সরোবর তৈরি করা, তাতে নিশ্চিত পদ্ম ফুটবে। তেমনি দেশের শিক্ষিত নাগরিক সমাজের উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর বিশুদ্ধকরণের জন্য চাপ সৃষ্টি করা। তা না হলে দেশের কল্যাণ সম্ভব নয়। কোনও মানুষই রাজনীতির ঊর্ধে নয়, রাজনীতি দেশের ঊর্ধে নয়। রাজনীতি বিনে দেশ নয়। অতএব সব উন্নতির, সব স্বাধীনতার, সব রাজনীতির সঠিক নেতৃত্বের দরকার, সঠিক নাগরিকের দরকার, শিক্ষার দরকার, ত্যাগের দরকার, আদর্শের দরকার, দায়িত্ববোধের দরকার, মানুষের দরকার। যোগ্য মানুষ হলে তৈরি হবে যোগ্য নাগরিক। তৈরি হবে যোগ্য নেতা, আমলা, পুলিশ ব্যবসায়ী।
কিন্তু তেমন পরিবেশ তৈরি হচ্ছে কি? স্ববিরোধিতায় ঠাসা আমাদের দেশের মানুষের অন্তর। মুখে ধর্ম, অন্তরে যে কোনও উপায়ে টাকা বানানোর ধান্দা দেশের কোটি কোটি মানুষকে এখনও স্বাধীনতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। দেশের লক্ষকোটি নিরন্ন বুভুক্ষ মানুষ খালি পেট, খালি গা, রুক্ষ চুল, কোটরে বসা চোখ, আর মাথায় দুনিয়ার দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘুমোতে যায়। প্রতিদিন গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয় অকুল অন্ধকার।
দেশের জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অসহায়ত্ব দেখে এখনও উদ্বিগ্ন হতে হয়। তাদের অনেক কিছুই নেই, সবচেয়ে বড় ‘নেই’ হচ্ছে নাগরিক অধিকার! নেই নিরাপত্তা, সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার। শাল্লার ঝুমন দাস, রামুর উত্তম, নাসিরনগরের রসরাজ, নারায়ণগঞ্জের শ্যামলকান্তি কিংবা গঙ্গাচরার টিটু রায়ের মতো যে কেউ যে কোনও সময় নিশানা হতে পারেন। কোনও একটা হুজুগ তুলে যে কোনও সময় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর যে কারও প্রতি হিংস্রতা নেমে আসতে পারে। মামলা হতে পারে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হতে পারে। যেমন হয়েছে সুনামগঞ্জে। এমন এক ভীতিকর পরিবেশে বাস করে কেবলই মনে হয়, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের এই দেশে বসবাসের অধিকার নেই!
যারা রাষ্ট্রের কাছে নিশ্চিত নিরাপত্তা পায় না, সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবার বল-ভরসা পায় না, উচ্চারণ করতে পারে না ‘কৃতজ্ঞ’ শব্দটা, যে সব অধিকার-বঞ্চিত, সন্ত্রস্ত মানুষ কেবলই ভয়ের প্রহর গোনে, তারা কী করে গাইবে, ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো?’ কী করে বলবে ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়?’
প্রায়ই প্রশ্ন জাগে, আসলে আমরা কোথায় চলেছি? ‘সত্যিই, কোথায় চলেছি’, এই প্রশ্নের উত্তর এখন কারও কাছেই পাওয়া যায় না। কারণ উত্তরটি সহজ নয়। এক কথায় বলা যায় না। কিন্তু মনে হয় বেশ কিছু ‘শিক্ষিত’ ও বিত্তশালী ক্ষমতাবান মানুষের হাতে দেশের সবকিছু চলে গেছে। তাঁরা ও তাঁদের সমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দল ও নেতারা ঠিক করছেন, দেশে কারা কতটুকু অধিকার ও সুযোগ নিয়ে টিকে থাকবেন।
চেষ্টা করা হচ্ছে দেশে আগ্রাসী, সংখ্যালঘু-বিরোধী একটি নতুন ও উগ্র ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ তৈরি করতে। কথায় কথায় ধর্মবিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। এ ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় গালিগালাজ ও অপছন্দের ব্যক্তিদের চরিত্রহননের মচ্ছব তো আছেই। রাজনৈতিক হিসেবটাও পরিষ্কার। মেরুকরণের রাজনীতির ফলে যদি সমস্ত মুসলিম ভোটকে একাট্টা করা যায়, তা হলে সংখ্যালঘু মানুষ কোণঠাসা বোধ করলেও তাঁদের বিরোধিতা করার কোনও ক্ষমতা থাকবে না। সেই সুযোগে তাদের সহায়-সম্পত্তি গ্রাস করে নেওয়া যাবে, ধর্মপরিচয়ের ভিত্তিতে বাংলাদেশ আবার একটি ‘পাকিস্তান’ হয়ে পুনর্জন্ম নেবে!
কিছু মানুষের এমন খায়েশ এবং এই খায়েশ পূরণের পথে নীরব কিন্তু ব্যাপক অভিযাত্রা দেখে সত্যিই খুব আফসোস হয়! কবির ভাষায় কেবলই বলতে ইচ্ছে করে:
‘‘বেড়া ভেঙে বুনো মোষ খেয়েছে ফসল
স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধ সবই কী বিফল?’’
লেখক: লেখক ও কলামিস্ট।
ইমেইল: [email protected]