ঢাকার পূর্বাচল নিউটাউনে শুরু হয়েছে মাসব্যাপী ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা-২০২৫। বুধবার (১ জানুয়ারি) এ মেলার উদ্বোধন করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি আন্তর্জাতিক এই মেলাতে দেশের তরুণ ও বয়স্কদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর বিষয়ে নিজের কিছু চিন্তাভাবনা তুলে ধরেন। এই ভাবনা দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে মজুবত করার পাশাপাশি জাতি গঠনে শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
এসময় দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি ও রপ্তানিমুখীপণ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসারও আহ্বান জানান ড. ইউনূস।
ড. ইউনূস বলেন, “মানুষ মাত্রই উদ্যোক্তা, শ্রমিক না। শ্রমিক হলো বিপথে চলে যাওয়া। এটা মানুষের পথ না। মানুষের পথ হলো সৃষ্টি করা। নিজের মনের মধ্যে যা আছে তা সৃষ্টি করা। অন্যের হুকুমে সৃষ্টি করা না। এটা হলো তফাৎ। একটি অন্যের চিন্তায়, অন্যের হুকুমে। আরেকটি হলো, নিজের চিন্তায়, নিজের ফুর্তিতে। এই মেলা আমাদেরকে আবার সেই সৃষ্টির সুড়সুড়িটা দেয়। একটা সুযোগ দেয় একজনেরটা দেখে আরেকজনের মাথায় সুড়সুড়ি দেওয়ার। এই সুযোগটা যেন আমরা গ্রহণ করতে পারি।
“আমার মনে মনে যে মেলার ছক। যেগুলো আছে সেগুলো তো থাকবেই। এর সঙ্গে আমরা আরও কিছু যোগ করতে পারি। এখনই করতে হবে এমন না। চিন্তাটা আমরা করতে পারি।”
তরুণদের পণ্য ও সেবা প্রদর্শনের জন্য মেলায় একটি অংশ রাখা যেতে পারে অভিমত দেন প্রধান উপদেষ্টা। তরুণদের মধ্যে আবার মেয়েদের জন্য একটা অংশ রাখার দরকার আছে বলেও মতামত জানান তিনি।
ড. ইউনূস বলেন, এরা একে অন্যের পণ্য বা সেবা দেখে বলবে আমি তো এর থেকে ভালো করতে পারি। বু্দ্ধিত বুদ্ধিতে ঘষা দিলে আরেকটি বুদ্ধি বের হয়।
তিনি বলেন, “প্রশ্ন উঠতে পারে দেশে এত লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণী, আমরা কয়জনকে জায়গা দেব। এটা কোনও সমস্যা না। সারা বছর ধরে মেলার প্রস্তুতি চলবে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতা হবে। ফাইনালি তাদের মধ্যে থেকে সেরাদের এই বাণিজ্য মেলায় জায়গা দেওয়া হবে। তাদের সমস্ত খরচ সরকার বহন করবে। এখানে যারা আসবে দেখবেন তারা কেবল বাংলাদেশের সেরা না, দুনিয়ার সেরা হয়ে গেছে।”
দেশ আর দুনিয়ার সীমারেখা এখন আর নাই– মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “তরুণরা আমাদের যে পর্যায়ে নিয়ে এসেছে, আমরা একাকার হয়ে গেছি। ফলে আন্তর্জাতিক তরুণরা দেখতে আসবে বাংলাদেশের তরুণরা কী করছে। বুদ্ধি নিতে আসবে। উৎসাহ নিতে আসবে। জয়েন্ট-ভেঞ্চার করতে আসবে। আজকে যেসব ব্যবসা ঘরে বসে পরিচালিত হচ্ছে, সেটা দেখা যাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হচ্ছে।”
তরুণদের পাশাপাশি অবসরপ্রাপ্তদের জন্যও মেলার একটি অংশ রাখার কথা বলে শান্তিতে এই নোবেল বিজয়ী। তিনি বলেন, “আমরা বলি রিটায়ার্ড। আমি বলি রিটায়ার্ড বলে কোনও শব্দ নাই। বরং শব্দটাকে রিটায়ারমেন্টে পাঠিয়ে দিলে ভালো হয়। একজন মানুষ কখনও রিটায়ার করতে পারে না। সে মৃত্যু পর্যন্ত কর্মঠ। কিন্তু আমরা একটা বয়স নির্ধারণ করেছি এত বছর পর সে রিটায়ার্ড। জোর করে একটি মানুষকে বিকল করে দিল শব্দ একটি আবিষ্কার করে। এই শব্দটিকে ডিকশনারি থেকে বের করে দিতে হবে।
“এই মেলায় তাদের জায়গা দেওয়া হলে মানুষ দলে দলে দেখতে আসবে এই ষাটোর্ধ্ব-সত্তরোর্ধ্ব মানুষগুলো কী করছে। ভবিষ্যতের বাণিজ্য মেলা সারা দেশজুড়ে হবে। পূর্বাচলের এই মেলা হবে চূড়ান্ত মেলা। এর আগে জায়গায় জায়গায় এই মেলা হবে।”
এর আগে তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা– তিনটি শব্দ। কারও খেয়াল আন্তর্জাতিকের দিকে, কারও খেয়াল বাণিজ্যের দিকে এবং কারও খেয়াল মেলার দিকে। আমি মেলার দিকে। এই মেলায় মানুষ আসে ফুর্তি করতে, সারা বছরের অনেক কিছু কেনাকাটা মানুষ জমিয়ে রাখে এই মেলার জন্য। এটা একটা ফুর্তির বিষয়ে পরিণত হয়েছে।”
মেলায় কেনাকাটার পাশাপাশি বিনিয়োগকারীরা বুদ্ধি নিতে আসবে বলেও মনে করেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, “বুদ্ধি টাকার চেয়ে বড় জিনিস। আমরা বলি টাকা নাই। এটা কোনও সমস্যা না। বুদ্ধি না থাকাটা সমস্যা। টাকা তো বুদ্ধির পেছনে দৌঁড়াবে। সবার বুদ্ধিকে একত্র করলে এটা মহাবুদ্ধিতে পরিণত হবে।”
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) আয়োজিত এই মেলায় প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট পণ্যকে বর্ষপণ্য ঘোষণা করা হয়। ফার্নিচার শিল্পকে ২০২৫ সালের বর্ষসেরা পণ্য হিসেবে ঘোষণা করেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
তবে তিনি বর্ষসেরা পণ্যের পাশাপাশি বর্ষসেরা উদ্যোক্তাকেও স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, “পণ্যের ওপর যেমন জোর, তার চেয়ে বেশি জোর দিতে চাচ্ছি, করলোটা কে?”
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সচিবের রুটিন দায়িত্বে) মো. আব্দুর রহিম খান, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. হাফিজুর রহমান।
জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে আঙ্গিকে সাজানো হয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় পূর্বাচলের বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারেই বসবে এই মেলা।
এবারের বাণিজ্য মেলায় এই প্রথম অনলাইনে বিভিন্ন ক্যাটাগরির স্টল বা প্যাভিলিয়ন স্পেস বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের সম্মানার্থে মেলায় তৈরি করা হয়েছে ‘ছত্রিশ জুলাই চত্বর’। তরুণসমাজকে রপ্তানি বাণিজ্যে উদ্বুদ্ধ করতে তৈরি করা হয়েছে ‘ইয়ুথ প্যাভিলিয়ন’।
মেলায় এ বছরই প্রথম সম্ভাবনাময় খাত বা পণ্যভিত্তিক সেমিনার আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদেশি উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠানের সুবিধার্থে থাকছে স্বতন্ত্র সোর্সিং কর্নার, ইলেকট্রনিকস ও ফার্নিচার জোন।
বিভিন্ন ক্যাটাগরির ৩৬১টি প্যাভিলিয়ন, স্টল ও রেস্তোরাঁ থাকছে এবারের মেলায়। দেশীয় বস্ত্র, যন্ত্রপাতি, কার্পেট, প্রসাধনসামগ্রী, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস পণ্য, আসবাব, পাট ও পাটজাত পণ্য, গৃহস্থালি সামগ্রী, চামড়া, আর্টিফিশিয়াল চামড়া, জুতাসহ চামড়াজাত পণ্য, খেলার সামগ্রী, স্যানিটারিওয়্যার, খেলনা, স্টেশনারি, ক্রোকারিজ, প্লাস্টিক, মেলামিন, পলিমার, হারবাল, টয়লেট্রিজ, ইমিটেশন জুয়েলারি, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য, ফাস্ট ফুড, হস্তশিল্পজাত পণ্য, গৃহসজ্জার উপকরণ মেলায় প্রদর্শন ও বিক্রয় হবে।
দেশীয় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিদেশি ৭ দেশের ১১ প্রতিষ্ঠান এবারের মেলায় অংশ নেবে। অংশগ্রহণকারী দেশগুলো হলো– ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, হংকং ও মালয়েশিয়া।
ব্যাংকিং সেবার জন্য মেলায় অনেক ব্যাংক অস্থায়ী এটিএম বুথ স্থাপন করেছে। মাসব্যাপী এ মেলা সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলবে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন খোলা থাকবে রাত ১০টা পর্যন্ত।
এবার মেলায় যাত্রী পরিবহনে বিশেষ ছাড় দিতে ইপিবি ও অ্যাপসভিত্তিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান উবারের মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর আওতায় ৫০ শতাংশ হারে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা পর্যন্ত ছাড়ে উবারের গাড়িতে মেলায় যাতায়াত করতে পারবেন যাত্রীরা। একই সঙ্গে যাতায়াতের সুবিধার্থে বিআরটিসির নির্ধারিত বাসসেবাও থাকবে। এছাড়া এবারই প্রথম মেলায় প্রবেশে ই-টিকিটিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর আওতায় কিউআর কোড স্ক্যান করে টাকা পরিশোধ করে মেলায় প্রবেশ করা যাবে।
দেশীয় পণ্যের প্রচার-প্রসার, বিপণন ও উৎপাদনে সহায়তায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ইপিবির যৌথ উদ্যোগে ১৯৯৫ থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা শুরু হয়। ২০২০ সাল পর্যন্ত মেলা হয়েছে আগারগাঁও শেরেবাংলা নগরে। কোভিড মহামারির কারণে ২০২১ সালে মেলা বসেনি। ২০২২ সাল থেকে পূর্বাচলে বসছে এ আন্তর্জাতিক মেলা।
মেলার সার্বিক নিরাপত্তা এবং দর্শনার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে মেলা প্রাঙ্গণে পর্যাপ্তসংখ্যক পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, র্যাব, গোয়েন্দা সংস্থাসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত রয়েছে বলে জানিয়েছে ইপিবি। এবারের মেলায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে।