দেড় দশক আগে জরুরি অবস্থা জারির পর সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে রাজনীতিতে নামতে দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন মুহাম্মদ ইউনূস। হালে পানি না পেয়ে সেপথ থেকে সরে এলেও এখনও সেই ঘটনার জের টানতে হচ্ছে বলে মনে করেন নোবেলজয়ী এই বাংলাদেশি।
সাম্প্রতিক নানা ঘটনার প্রেক্ষাপটে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “১০ সপ্তাহের সেই ঘটনার জন্য সারাজীবন আমাকে খেসারত দিতে হবে?”
শনিবার বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটে এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়। এতে জরুরি অবস্থার সময় রাজনৈতিক দল গঠনের পথে তিনি কেন গিয়েছিলেন, তার ব্যাখ্যা এবং বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি কথা বলেন।
২০০৬ সালে ইউনূস শান্তিতে নোবেল জয়ের পরের বছরই বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে জরুরি অবস্থা আসে। সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন হলেও তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের ইশারায় সরকার চলত বলে স্পষ্ট।
তখন দুই প্রধান রাজনৈতিক নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে বন্দি করা হয়েছিল। তাদের রাজনীতি থেকে দূরে সরানোর প্রক্রিয়াও চলেছিল। পাশাপাশি চলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়াস, যেগুলো ‘কিংস পার্টি’ নামে পরিচিতি পায়।
ওই সময়ই রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন ইউনূস। সেই দলের নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘নাগরিক শক্তি’।
সেই দল গঠনের ক্ষেত্রেও চাপ ছিল দাবি করে বিবিসি বাংলাকে ইউনূস বলেন, “সেই সময় সেনাবাহিনী তো আমার কাছেই আসলো। তারা আমাকে বললো, আপনি সরকার প্রধান হবার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারা আমাকে বলেছিল, বাংলার মসনদ আপনার হাতে, আপনি এটাতে বসেন।
“আমি বলেছি, নাহ আমি তো বসব না। আমি তো রাজনীতি করি না। আমি তো রাজনীতির মানুষ না।”
তারপরও একই চাপ আসতে থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, “বারে বারে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হলো। কখনও ভয় দেখানো হলো, কখনও উৎসাহ দেওয়া হলো যে এটা মস্ত বড় সম্মানের বিষয়।
“আমি প্রতিবারই জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছি আমি এই দায়িত্ব গ্রহণ করব না। তারা তারপরও আসার কথা বলল। কিন্তু আমি আমার অবস্থান পরিবর্তন করবো না বলেই জানিয়েছিলাম।”
তবে এক পর্যায়ে রাজনীতিতে নামায় সায় দিয়েছিলেন ইউনূস।
তিনি বলেন, “আমাকে নানা রকম চাপের মধ্যে ফেলা হলো। তখন আমি সবাইকে চিঠি দিলাম, সবার মতামত নিতে থাকলাম। পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত আসলো। তখন দলের নাম কী হবে, সেটা নিয়ে কৌতূহল ছিল। আমি একটা নাম দিলাম নাগরিক শক্তি। পরবর্তী একটা সময় বলে দিলাম, নাহ আমি আর এই রাজনীতিতে নাই, আমি রাজনীতি করতে চাই না।”
ইউনূস পরে বিভিন্ন সময়ে বলেছিলেন, তিনি আর কখনও রাজনীতিতে জড়াবেন না। বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও বলেন, রাজনৈতিক দল গঠনে তার সেই সিদ্ধান্ত ‘ভুল ছিল।।
সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের শাসনকালে ইউনূসের উদ্যোগে সরকারি সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গ্রামীণ ব্যাংক। সেই ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি।
জরুরি অবস্থা অবসানের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে বয়সের কারণ দেখিয়ে তাকে সেই পদ থেকে অপসারণ করা হয়। সেই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে আদালতে গিয়ে হেরে ২০১১ সালে গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়তে হয় ইউনূসকে।
এরপর থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ইউনূসের বৈরী সম্পর্ক নানা সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও থাকছে আলোচনায়।
গ্রামীণ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে শ্রম আইন লঙ্ঘন, অর্থ পাচারসহ নানা মামলায় এখন জড়িয়ে আছেন ইউনূস। একটিতে তার ছয় মাসের কারাদণ্ডও হয়েছে। তার গড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সম্প্রতি গ্রামীণ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ঘটনাও ঘটে।
এসবের পেছনে সরকারের হাত রয়েছে বলে ইউনূসের দাবি। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এর সবগুলোই আইনি বিষয়, আর আদালতের উপর সরকারের কোনও হস্তক্ষেপ নেই।
সরকারের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক কেন হলো- এই প্রশ্নে ইউনূস বলেন, “এটা অদ্ভূত একটা বিষয় না? কী গভীর সম্পর্ক হওয়ার কথা ছিল, এখন সেই প্রতিষ্ঠানের নাম নিয়ে জঙ্গিভাবে হামলা করতে আসছে। কেন এমন হচ্ছে?”
আওয়ামী লীগের শাসনকাল নিয়ে সমালোচনা বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও বলেন ইউনূস।
“আমরা এখন গণতন্ত্রহীন অবস্থায় আছি। আমি ভোট দেই নাই। অনেকেই ভোট দেয় নাই। আমি তো ভোটে অংশগ্রহণ করতে পারি নাই। অনেকে পারে নাই। ভোট যদি আমি না দেই। অংশগ্রহণ যদি না করতে পারি। তাহলে সেটা কোন গণতন্ত্র?”