অলিম্পিক ও বিশ্বকাপে বাংলাদেশি খেলোয়াড়রা পদকের ধারেকাছেই থাকেন না। কিন্তু এ দেশের তৈরি ক্রীড়া সরঞ্জামের সদর্প উপস্থিতি থাকে ওসব ক্রীড়া মহাযজ্ঞে। দেখা যায়, এখানকার তৈরি আর্চারি তীর, গলফ শ্যাফট বা জার্সি পরে পদক জিতছেন বিশ্ব তারকারা। অথচ দেশে তৈরি ওসব উন্নত ক্রীড়া সরঞ্জামের খবরই জানেন না দেশি তারকারা। এ নিয়েই সকাল সন্ধ্যার রাহেনুর ইসলাম – এর চার পর্বের ধারবাহিক। আজ দ্বিতীয় পর্বে থাকছে গলফ শ্যাফট।
চট্টগ্রাম ইপিজেডে মামিয়া-ওপির দপ্তরে ঢুকতেই দেখা মিলবে টাইগার উডসের বাঁধানো ছবি। কারণ, মামিয়া-ওপির তৈরি গলফ শ্যাফটে খেলেন ১৫টা মেজর জয়ী যুক্তরাষ্ট্রের এই কিংবদন্তি। মানে টাইগারের সাফল্যে ছোঁয়া আছে বাংলাদেশেরও।
শুধু টাইগার উডস নন, সময়ের সেরা বেশিরভাগ গলফারই ব্যবহার করেন মামিয়া-ওপির তৈরি গলফ শ্যাফট। এগুলো ব্যবহার করেন শৌখিন গলফাররাও। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতেও দেখা গেছে চট্টগ্রামে তৈরি গলফ শ্যাফট!
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একমাত্র গলফ শ্যাফট কারখানা
মামিয়া-ওপি চট্টগ্রাম ইপিজেডে ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অলিম্পিক-এমআই নামে। ১৯৯৪ সালে নাম বদলে তারা হয় মামিয়া-ওপি। শুরুতে তারা উৎপাদন করতো ফিশিং রিল। ২০১১ সালে যোগ হয় গলফের হ্যান্ড গ্লাভস। এর দুই বছর পর থেকে শুরু গলফ শ্যাফট উৎপাদন।
এরপর ফিশিং রিল বাদ দিয়ে মামিয়া-ওপি হয়ে উঠেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একমাত্র গলফ শ্যাফট কারখানা। তারা তৈরি করে বিশ্বখ্যাত টেইলরমেড ব্র্যান্ডের গলফ শ্যাফট। এই ব্র্যান্ডের শ্যাফট দিয়েই খেলেন টাইগার উডস। এছাড়া তারা তৈরি করে ক্যালওয়ে, পিংক, ইউএসটি মামিয়া আর এক্সিভ ব্র্যান্ডের গলফ শ্যাফট। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প খেলেন এক্সিভ ব্র্যান্ডের গলফ শ্যাফটে। এটাও তৈরি হয় এই কারখানায়।
গলফ শ্যাফট তৈরি হয় যেভাবে
মামিয়া-ওপি জাপানের প্রতিষ্ঠান। শুরুতে গলফ শ্যাফট তৈরির প্রশিক্ষণ দিতে বাংলাদেশ থেকে জাপানে নিয়ে যাওয়া হয় ২৫-৩০ জনকে। তারা প্রশিক্ষিত হয়ে এসে এখন কাজ শেখাচ্ছেন স্থানীয়দের। এখন সবমিলিয়ে ১২৮০জন কাজ করেন এই কারখানায়। তাদের কেউ দক্ষ গলফ শ্যাফট তৈরিতে, কেউ আর্চারির তীরে, কেউবা স্ট্যাবলাইজারে।
গলফ শ্যাফট তৈরিতে কাঁচামাল হচ্ছে মূলত কার্বন ফাইবার। এটা প্রথমে কাটিং প্রসেস করার পর আসে আয়রনিং ও রোলিং প্রসেসে। রোলিংয়ের পর হয় কিউরিং, এরপর চলে যায় সেন্ডিংয়ে। সেখান থেকে ইনসপেকশন হয়ে ফিনিশিং জোনে। সবশেষ ধাপ কিউসিতে। এরপর প্যাকেট করে প্রস্তুত করা হয় রপ্তানির জন্য।
পুরো প্রক্রিয়াটা জানিয়ে মামিয়া-ওপির সহকারী মহাব্যবস্থাপক (প্রোডাকশন) অসীম কুমার চৌধুরী বললেন,‘‘প্রতিটা ধাপে আমাদের দক্ষ লোকবল আছে। তাদের অনেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন জাপান থেকে। টেইলরমেড, ক্যালওয়ে, পিংক, ইউএসটি মামিয়া, এক্সিভের মতো ব্র্যান্ড শতভাগ আস্থা রাখে আমাদের ওপর।’’
মামিয়া-ওপির কাজে মুগ্ধ হয়ে বাংলাদেশি এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিজেই গলফ শ্যাফটের একটি ব্র্যান্ড চালু করতে যাচ্ছেন টাইগার উডস। তার প্রতিষ্ঠানের নাম ‘সানডে রেড’ হবে বলে জানান ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আবুল হাসনাত হেলাল।
রপ্তানির অঙ্ক
মামিয়া-ওপি ব্যবস্থাপক (কারখানা) মাকোতা শিবুতা জানালেন, ‘‘প্রতি মাসে আমরা তিন লাখ ২০ হাজার পিস গলফ শ্যাফট উৎপাদন করতে পারি। তবে মাসে ২ লাখ বা ২ লাখ ২৫ হাজারের মতো উৎপাদন হয় এখন। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের বাজারেই রপ্তানি করে থাকি আমাদের পণ্য।’’
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৯ সালে মামিয়া-ওপি ১০.৭৬ মিলিয়ন ডলারের গলফ শ্যাফট, ফাইবারের রেলওয়ে পুল ও তীর রপ্তানি করেছিল। ২০২০ সালে ১৭.৭ মিলিয়ন ডলার আর ২০২১ সালে ২৩.২ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে। ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে অঙ্কটা গড়ে ২২ মিলিয়ন ডলারের মতো।
তাদের লক্ষ্য এখন বছরে ৩০ মিলিয়ন ডলার। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আবুল হাসনাত হেলালের বিশ্বাস এটা অসম্ভব নয়, ‘‘আমাদের শ্রমিকদের বেতন কম। এজন্য উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে লড়াই করতে পারছি পাল্লা দিয়ে। ৩০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করাটা আকাশ-কুসুম কল্পনা নয় মোটেও।’’
বিস্মিত সিদ্দিকুর রহমান
এদেশে গলফ ছিল শৌখিন খেলা। বলা যায়, ক্যান্টনমেন্টে বন্দী খেলাটিকে জনতার সামনে আলাদা করে তুলে ধরেন সিদ্দিকুর রহমান। খেলাটির বড় বিজ্ঞাপন এই গলফারই। ২০১০ সালে এশিয়ান ট্যুর জিতে প্রথম গলফ নিয়ে হুল্লোড় তৈরি করেন তিনি। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তিনি ২০১৬ সালে সরাসরি রিও অলিম্পিকে অংশ নেন।
বাংলাদেশে গলফ শ্যাফট তৈরি হয় জেনে সিদ্দিকুর রহমান সকাল সন্ধ্যার কাছে লুকাননি নিজের বিস্ময়, ‘‘সত্যি বলতে এ নিয়ে কোনো ধারণা ছিল না আমার। আমি বিস্মিত, অভিভূতও। টাইগার উডসের মতো তারকা আমাদের দেশের তৈরি গলফ শ্যাফটে খেলেন, অনেক বড় ব্যাপার এটা।’’
আপনি কোন ব্র্যান্ডের গলফ শ্যাফটে খেলেন? জানতে চাইলে সিদ্দিকুর বললেন,‘‘ক্যালওয়ে ব্র্যান্ডের’’। এটা যে মায়ামি-ওপিতে তৈরি জানেন কি? এমন প্রশ্নে সিদ্দিকুরের বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ল আরও, ‘‘তাহলে তো ওদের কারখানায় যেতে হয় একদিন?’’
সিদ্দিকুর ক্যালওয়ে ব্র্যান্ডের গলফ শ্যাফটে খেলেন জানার পর মামিয়া-ওপির ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আবুল হাসনাত হেলাল মজা করে বললেন,‘‘এখন দেখছি টাইগার উডসের মতো সিদ্দিকুর ভাইয়ের ছবিও আমাদের কারখানায় লাগাতে হবে! ভাইকে অবশ্যই আনব আমাদের কারখানায়।’’
বাংলাদেশের আরেক গলফার জামাল হোসেন ভারতের পিজিটিআই টুর্নামেন্টে জিতেছেন পাঁচটি শিরোপা। সবশেষটি ২০২৪ সালে আসামের ডিগবইয়ে ইন্ডিয়ান অয়েল সার্ভো মাস্টার্স।
বাংলাদেশে তৈরি গলফ শ্যাফট নিয়ে প্রশ্ন করলে জামাল জানালেন, ‘‘বাংলাদেশের শ্যাফট টাইগার উডসের ব্যবহার করাটা অবশ্যই গর্বের। আমি স্যারক্সন শ্যাফটে খেলি, এটা যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। আমার জানা মতে মামিয়া-ওপি জাপানি কোম্পানি। ওরা যেহেতু বাংলাদেশেও এত বড় কারখানা করে ফেলেছে, ওদের উচিত প্রচারণায় আসা। সারা দেশের মানুষের কাছে পরিচিতি বাড়বে তাতে। এটা তো দেশের জন্যই গৌরবের।’’